রবিবার, ২০ জানুয়ারী, ২০১৩

জাহাজ ভাঙা শিল্প : একটি সিলভার লাইনিং

মাউন উল করিম : একটা সময় ছিল যখন সমুদ্রপথে চলাচলের ক্ষেত্রে কাঠের তৈরী জাহাজ ব্যবহার হতো। সময়ের বিবর্তনে এইসব কাঠের জাহাজগুলো বিলুপ্ত হয়ে তার জায়গা দখল করলো মাইল্ড স্টিল, স্টেইনলেস স্টিল সহ অন্যান্য ধাতুর মিশ্রণে নির্মিত দানবাকৃতির জাহাজ। আর্ন্তজাতিক প্রতিষ্ঠান ‘লয়েডস শিপিং রেজিষ্টার’ এর হিসেব মতে যুদ্ধ জাহাজ বাদে বর্তমানে সারাবিশ্বে কন্টেইনার, কার্গোবাহি ট্যাঙ্কার, ক্রুজ লাইনার, ফেরী ইত্যাদি সহ সমূদ্রগামী জাহাজ রয়েছে প্রায় ৫০হাজার। মিশ্রধাতু নির্মিত একটি জাহাজ চলাচলের উপযোগি থাকে গড়ে ২৫ বছর। ২৫ বছরের আয়ূস্কাল শেষে চলাচলের অযোগ্য হয়ে স্ক্র্যাপ অন্তর্ভূক্ত হয় বছরে গড়ে অন্তত ৭০০ টি জাহাজ। আধুনিক বিশ্বে জাহাজের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে পরিত্যক্ত জাহাজের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু এই মিশ্রধাতুর অতিকায় দানবগুলোকে পরিত্যক্ত অবস্থায় পুরোপুরি ধ্বংস করা সম্ভব না। আবার স্থানাভাবে জমিয়ে রাখাও অসম্ভব। এসব কারনে জাহাজগুলোর বিভিন্ন অংশ ও লৌহজাত পন্যগুলো সংগ্রহ করে তা অন্য কাজে ব্যবহারের চিন্তা থেকেই আধুনিক জাহাজ ভাঙা শিল্পের জন্ম।
তবে বাংলাদেশে এর শুরুটা হয় একটু অন্যভাবে। চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড - শহর থেকে একটু দুরে চট্টগ্রাম জেলার অনন্য বৈশিষ্ট মন্ডিত একটি শিল্পসমৃদ্ধ উপজেলা। এই এলাকাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে দেশের একমাত্র জাহাজ ভাঙা শিল্প। জানা যায় ১৯৬০ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণীঝড়ের কবলে পড়ে গ্রীক পতাকাবাহি ‘এম ভি আল পাইন’ নামের একটি জাহাজ এসে আটকে পড়ে সীতাকুন্ড উপজেলার সন্দীপ চ্যানেলের শীতলপুর উপকূলে। আটকে পরা জাহাজটিকে কোনোভাবেই উদ্ধার না করা গেলে তা কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়। ‘চিটাগাং স্টিল হাউজ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান জাহাজটি কিনে নেয় এবং ১৯৬৫ সালে ভাঙার মাধ্যমে গোড়াপত্তন হয় সীতাকুন্ডের জাহাজ ভাঙা শিল্পের। এরপর বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের সহায়তায় আমদানী শুরু হয় পরিত্যক্ত স্ক্র্যাপ জাহাজের। ৮০’র দশকে শিপব্রেকিং ইয়ার্ডের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬০-৮০টিতে। বর্তমানে সীতাকুন্ডের ফৌজদারহাট থেকে শুরু করে কুমিরা পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে প্রায় ১০৫টি ইয়ার্ড কাজ করছে। সীপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে ভাঙার জন্য আনা অধিকাংশ জাহাজই বিপদজনক অয়েল ট্যাঙ্কার। এখানে শিপব্রেকিং ইয়ার্ড মালিকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স এসোসিয়েশন (বিএসবিএ) গঠন করা হলেও শ্রমিকদের স্বার্থ সুরক্ষায় তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য সংগঠন নেই। 

এটা অনস্বীকার্য যে স্ক্র্যাপ জাহাজের আসবাবপত্র, তৈজসপত্র, ইলেক্ট্রিকাল এবং ইলেক্ট্রনিক্স পন্য, মেশিনারী সহ হরেক রকম পন্যের ব্যবসা গড়ে উঠে সীতাকুন্ডে যা ধীরে ধীরে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। এর মেশিনারি ও ধাতব উপাদানগুলো রপ্তানীও হচ্ছে বিদেশে। লোহার রড জাতীয় পন্য উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল ‘স্ক্র্যাপ’ যোগানের প্রধান উৎস শিপব্রেকিং ইয়ার্ডের কল্যাণে সারাদেশে গড়ে উঠেছে প্রায় ৪৫০টি স্টিল রি-রোলিং মিল। শিপব্রেকিং শিল্প সংশ্লিষ্ট বিশাল ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছে অন্তত অর্ধ-কোটি মানুষের কর্মসংস্থান। কিন্তু এই শিল্পের মাধ্যমে শিল্পোন্নয়নের বিস্তার যেমন ঘটেছে তেমনি গাছ কেটে উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনি ধ্বংস এবং মারাত্মক পরিবেশ দূষণের অভিযোগও উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, ইউএনডিপির অর্থায়নে এবং আইএলও’র সহযোগিতায় বাংলাদেশ সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় শ্রমিকদের কাজের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ‘সেফ এন্ড এনভায়রণ ফ্রেন্ডলী শিপ রিসাইকিং প্রজেক্ট’ হাতে নিলেও এর কাঙ্খিত বাস্তবায়ন হচ্ছেনা। চট্টগ্রামের শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় গত ১২ বছরে নিহত হয়েছে কমপক্ষে এক হাজার তিনশ' বিভিন্ন স্তরের শ্রমিক। আহত হয়েছে আরো কয়েক হাজার। যাদের অনেকেই চলাচলে অক্ষম বা পঙ্গু হয়ে গেছে সারা জীবনের জন্য। বিভিন্ন সময় দুর্ঘটনা সংক্রান্ত প্রকাশিত সংবাদ, অন্যান্য সূত্র এবং শ্রমিকদের বক্তব্য অনুসারে শিপইয়ার্ডে কাজ করার সময় নানামুখী দুর্ঘটনায় প্রতি সপ্তাহে গড়ে একজন শ্রমিক মারা যাচ্ছে। প্রতিদিন গড়ে দুই শ্রমিকের আহত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। অভিযোগ রয়েছে, ইয়ার্ডের মালিকরা অধিকাংশ সময় এসব দুর্ঘটনা আড়ালের চেষ্টা করেন। গোপন করেন হতাহতের প্রকৃত তথ্য। সুযোগ বুঝে শ্রমিকের মৃতদেহ সাগরে ভাসিয়ে দেওয়ার মত ঘটনাও ঘটেছে। দুই-তিন একর জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠে এক-একটি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড। এই বিশাল এলাকা কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনির মধ্যে থাকায় সাধারণ দুর্ঘটনা ঘটলে বাইরের সাধারণ মানুষের তা জানার কোনো সুযোগ থাকে না। তবে জাহাজ কাটার সময় ট্যাংকার বিস্ফোরণ, জাহাজে আগুন ধরে দুর্ঘটনা ঘটলে তা প্রকাশ পেয়ে যায়। ইয়ার্ডগুলোতে প্রায়ই ঘটে লোহার ভারি প্লেটের চাপা পড়া, কালো তেলে পা পিছলে পড়ে যাওয়া বা যন্ত্রপাতি ওঠানো-নামানের সময় জাহাজের উপর থেকে পড়ে যাওয়ার মতো দুর্ঘটনা। এছাড়া জাহাজের বিভিন্ন রাসায়নিক বিষাক্ত তরল পদার্থ ও গ্যাসের বিষক্রিয়ায় কর্মরত শ্রমিকরা মারাত্মক সব রোগে আক্রান্ত হয়েও মারা যায়। দুর্ঘটনার বাইরে বিষাক্ত উপাদানের কারণে সৃষ্ট অসুখে মারা যাওয়া শ্রমিকদের পরিসংখ্যান পুরোপুরিই অজানা। আবার শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে কর্মরত অবস্থায় হতাহত শ্রমিকদের পরিবার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো ক্ষতিপূরণ পায় না। দেয়া হয় না আহতদের জন্য চিকিৎসা সুবিধাও। শ্রম আদালতে মামলা করে কেউ কেউ কিছু ক্ষতিপূরণ আদায়ে সম হলেও বেশির ভাগ শ্রমিক মামলা সংক্রান্ত ঝামেলায় যেতে চায় না। 

আর্ন্তজাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও ২০০৩ সালে জাহাজ ভাঙা শিল্পকে ঝুকিপূর্ণ, বিপদজনক ও পরিশ্রমসাপেক্ষ হিসাবে উল্লেখ করে। ওই সময় সংস্থার পক্ষ থেকে এই শিল্পের জন্য একটি নির্দেশাবলী প্রণয়ন করা হয়। ওই নির্দেশাবলীর উদ্দেশ্য ছিল কর্মক্ষেত্রে ঝুঁকি থেকে শ্রমিকদের রক্ষা এবং দূষণের ফলে সৃষ্ট সম্ভাব্য রোগ ও দুর্ঘটনা হ্রাসে অবদান রাখা। কিন্তু বাস্তবে শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলো আইএলও'র এই নির্দেশনা কোনোভাবেই অনুসরন করে না। আর মূলত সরকারের ঢিলেঢালা মনোভাবের কারণে এই শিল্পটির মূল শক্তি, এর শ্রমিকেরা সবসময়ই থেকে যাচ্ছে অবহেলিত। তাই অনতিবিলম্বে সরকারের কাছ থেকে একটি সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা এবং তার যথার্থ প্রয়োগই পারে দেশের শিল্পোন্নয়নে বিশাল অবদান রাখা এই শিল্পের অগ্রগতি ও ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে। সেই সাথে ইয়ার্ড মালিকপক্ষের ইতিবাচক মানসিকতাতো থাকতেই হবে। আর তাহলেই কেবল পরিবেশ বিপর্যয় ও নিরাপত্তাহীনতার মেঘ কেটে সিলভার লাইনিংটা আরো উজ্জ্বল হবে এবং এক সময় সূর্যের আলোয় ঝলমল করবে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনাময় এই শিল্পটি।