সোমবার, ২৫ মার্চ, ২০১৩

আবার এলো ২৫ মার্চ

মাউন উল করিম : দিনটি ছিল বৃহষ্পতিবার৤ প্রায় মধ্যরাতে গভীর ঘুমে ছিল সেদিন ঢাকা শহর৤ হঠাৎ করেই মৃত্যু যেন রাতের কালোর চাইতেও বেশী কালো করে দিয়েছিল সবকিছু সেই রাতে৤ পাকি সামরিক জান্তার সেনানিবাসের ট্যাংকগুলো মৃত্যুদুত হয়ে নেমে আসে রাস্তায়৤ সেই একাত্তরের বিভীষিকাময় কালরাতের স্মৃতি জাগানিয়া ২৫ মার্চ আজ। সেই সময়টিতে বাঙালির হৃদয় জুড়ে ছিল একটি পতাকার রঙ... স্বপ্নচেতনা জুড়ে ছিল একটি মুক্ত ভূখন্ডের আশা। সারা দেশ ছিল উত্তাল আন্দোলনে। 
ধীরে ধীরে নেমে আসা রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে রাজপথে শোনা যায় ভারী জিপ গাড়ি আর ট্রাকের শব্দ। অন্ধকারে হিংস্র শ্বাপদের মতো  অবস্থান নেয় ট্যাংক আর সাঁজোয়া যান। আর এভাবেই রচিত  হয় ‘অপারেশন সার্চলাইটে’র প্রথম পর্ব : মানব ইতিহাসের নিকৃষ্টতম গণহত্যা। ঘুমন্ত মানুষের ওপর  হিংস্রতায় ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিদের লেলিয়ে দেয়া সেনারা। রক্তে নগর, জনপদ ভেসে যায় ।

একাত্তরের আগুনঝরা মার্চে সর্বকালে সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, এই বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণে স্বাধীনতার চূড়ান্ত সংগ্রামের ডাক দেয়ার পর পাকিস্তানি সামরিক জান্তা আলোচনার নামে কালক্ষেপণের আড়ালে ঢাকায় বিপুল সৈন্য সমাবেশ ঘটাতে থাকে । যার ধারাবাহিকতায় ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে ঘুমন্ত, নিরস্ত্র জনতার ওপর পৈশাচিক হামলা চালিয়ে হত্যা করে অগণিত নারী-পুরুষ-শিশুকে। এ কালরাতেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী একযোগে হামলা চালায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে, শিক্ষকদের বাসভবনে, তৎকালীন ইপিআর-এর সদর দপ্তর পিলখানায়, ভয়ঙ্কর আক্রমণ চালানো হয় রাজারবাগ পুলিশ লাইনে, পুরান ঢাকার শাঁখারী বাজারসহ সারা ঢাকাজুড়ে। শুরু হয় নির্বিচার হত্যা, ধর্ষণ আর লুটপাট। অগ্নিসংযোগ করা হয় হাজার হাজার বাড়িতে। গুড়িয়ে দেয়া হয় শহীদ মিনার৤ গ্রেপ্তার হন বঙ্গবন্ধু। গ্রেপ্তারের আগে দিয়ে যান স্বাধীনতার ঘোষণা।  বঙ্গবন্ধুর ডাকে উজ্জীবিত বাঙালি ২৫ মার্চের ভয়াল রাতের পর নতুন করে উজ্জীবিত হয়। প্রস্তুত হয় নৃশংস গণহত্যার প্রতিশোধের নেশায়। ঝাঁপিয়ে পড়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে। এরপর দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতা। জন্ম নেয় বাংলাদেশ।

আজ ৪২ বছর পর আবার এলো ভয়াল স্মৃতিবহ ২৫ মার্চ৤ তবে এবারের ২৫শে মার্চ এসেছে এক বিশেষ তাৎপর্য নিয়ে৤  বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে দেয়া অঙ্গীকার অনুযায়ী ৭১এর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চলছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। সেই সাথে গত দেড় মাসেরও বেশি সময় ধরে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে চলছে আন্দোলন। এই আন্দোলন মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণজাগরণ সৃষ্টি করেছে। তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে একাত্ম হয়ে সব যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি এবং যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত দল  জামাত-শিবির নিষিদ্ধের দাবি উঠছে দেশ ব্যাপি। অন্যদিকে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার রুখতে গৃহযুদ্ধ বাধানোর হুমকি দিয়ে মাঠে নেমেছে বিরোধীরা। তারা সারা দেশে সশস্ত্র তান্ডব শুরু করেছে। ধর্মের নামে অপপ্রচার চালিয়ে নিরীহ ধর্মপ্রাণ মানুষকে উসকে দেয়ার চেষ্টা করেছে। আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক জাতীয় পতাকা দ্বিখন্ডিত করেছে। পবিত্র শহীদ মিনার ভাঙচুর করেছে।  এত ডামাডোলে আবারো এসেছে সেই রক্তঝরা ২৫ মার্চ।  আজ আমাদের তরুণ প্রজন্ম রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সেই একাত্তরের চেতনায় একটি সমৃদ্ধ, মর্যাদাশীল, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার লড়াইয়ে নেমেছে। আজ আমরা ২৫ মার্চ কালরাতের শহীদদের গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করবো। সেই সঙ্গে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবো মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ থেকে সব অন্ধকারের অপশক্তি সমূলে দূর করার।