মাউন উল করিম : বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ। নতুন বছরের শুরুর দিন, হালখাতার দিন। বৈশাখের প্রথম দিন থেকে বাঙালি-জীবনে নতুন বছরের সূচনা। নতুন জীবনের গোড়াপত্তন। বৈশাখের সঙ্গে বাঙালি-জীবনের একটা অতি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। নবান্নের পর মানুষ এ মাসে যেন কর্মক্লান্ত জীবনের মাঝে অনাবিল স্বস্তি ফিরে পায়। বছরের অন্যান্য মাসে যেন সারা দিনমান ক্ষেত্রে খামারে কাজ করতে হয়, বৈশাখে এসে জীবনের ধারা বদলে যায়। এর মাঝে বাংলাদেশের মানুষ খুঁজে পায় এক নতুন আস্বাদ, নতুন করে জীবন চলার পথের উপাদান, প্রেরণা আর উদ্দীপনা। তাই বাঙালি জীবনে এ মাসের গুরুত্ব অপরিসীম।
বৈশাখে উৎসবের ঢল নেমে আসে। মেলা বসে গ্রামে গ্রামে। শহরে-নগরে গঞ্জে। কত না বিচিত্র হাতের তৈরি দ্রব্যসম্ভার সেসব মেলায় বিক্রি হয়। সে সকল দ্রব্যসামগ্রীতে বাংলার মানুষের বৈচিত্র্যময় জীবনধারার একটা স্পষ্ট চিত্র ফুটে ওঠে। এ সকল মেলা যেন গ্রাম-বাংলার মানুষেরই প্রতিচ্ছবি। তাদের জীবন যেন খন্ড খন্ড হয়ে ধরা পড়ে তাদের হাতের কারুকাজে। তারা খুশিতে গান গায়, তারা আনন্দে নাচে, তারা সংগীতের আসরের আয়োজন করে।
বাংলাদেশে প্রতি মাসে একটা না একটা পার্বণ লেগেই আছে। তাই বলা হয়, বাংলাদেশ বারো মাস তেরো পার্বণে দেশ। বৈশাখ মাসেও প্রবাদের সেই বাণীর কথা নানান পার্বণের মাঝ দিয়ে প্রতিফলিত হয়। পালা-পার্বণের এই দেশে সামাজিক অনুষ্ঠান লেগেই আছে। জাতিগতভাবেও বাঙালি ঐতিহ্যময় সংস্কৃতি ও কৃষ্টির দেশ। সামাজিক অনুষ্ঠানে নানা ধরনের গান পরিবেশিত হয় যাতে বাংলার মানুষের প্রাণের কথা, মনের ভাষা, হৃদয়ের আবেদন আর অন্তরের আকুলতা অত্যন্ত বাস্তব হয়ে ধরা পড়ে। মাঠের গান, বাটের গান, লোকগান বাংলা মানুষের আপন সংস্কৃতি। এতে রয়েছে পল্লী মানুষের সহজ-সরল ভাবের প্রকাশ। এতে শাস্ত্রীয় সংগীতের জটিলতা নেই। সুরের বক্রতা নেই। আছে শুধু সহজ-সরল অনুভূতি আর আবেদন। এ সঙ্গীত চিরায়ত। এতে আছে মাটির কাছাকাছি মানুষের প্রাণের ছোঁয়া।
পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশের মানুষের সামাজিক পার্বণের বিচিত্র সমারোহে জড়িয়ে থাকা প্রকৃতির এক নব অভিষেক। প্রকৃতির নিয়মানুসারে কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া গাছের শাখায় শাখায় লাল-হলুদ ফুলের রঙিন উচ্ছ্বাস যেমন এক নতুন সম্ভাবনার প্রতিচ্ছবি তোলে, নববর্ষের আনন্দোচ্ছল পহেলা বৈশাখ যেন সেই উচ্ছ্বাসেরই আরেক রূপ। এ সকল রূপের কথাই কবি লিখেন কবিতায় আর গীতিকার গানে।
১৫৫৬ সালে শুরু হয়েছিল বাংলা সনের। মোগল সম্রাট জালালউদ্দনি মোহাম্মদ আকবররে সিংহাসনে আরোহনরে দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে তার রাজস্ব র্কমর্কতা আমির ফতহেউল্লাহ সিরাজী প্রথম ১৫৫৬ সালে উৎসব হিসেবে বৈশাখকে পালন করার নির্দেশ দেন। একই ধারাবাহিকতায় ১৬০৮ সালে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীররে নির্দেশে সুবদোর ইসলাম খা চিশতি ঢাকাকে যখন রাজধানী হিসেবে গড়ে তুলেন, তখন থেকেই রাজস্ব আদায় ও ব্যবসা বাণিজ্যের হিসাব-নিকাশ শুরু করার জন্য বাংলা বছরের পহলো বৈশাখকে উৎসবরে দিন হিসেবে পালন শুরু করনে। ঐতিহাসিক তথ্যে আছে যে, সম্রাট আকবরের অনুকরণে সুবদোর ইসলাম চিশতি তাঁর বাসভবনরে সামনে সব প্রজার শুভ কামনা করে মিষ্টি বিতরণ এবং বৈশাখ উৎসব পালন করতেন। সেখানে সরকারি সুবদোর হতে শুরু করে জমিদার, কৃষক ও ব্যবসায়ীরা উপস্থিত থাকতেন। প্রজারা খাজনা নিয়ে আসত সেই উপলক্ষে সেখানে খাজনা আদায় ও হিসাব-নিকাশের পাশাপাশি চলত মেলায় গান-বাজনা, গরু-মোষের লড়াই, কাবাডি খেলা ও হালখাতা অনুষ্ঠান।
পরবর্তীতে ঢাকা শহরে মিটর্ফোডরে নলগোলার ভাওয়াল রাজার কাচারিবাড়ি, বুড়িগঙ্গার তীরর্বতী ঢাকার নবাবদের আহসান মঞ্জিল, ফরাসগঞ্জ এর রূপলাল হাউস, পাটুয়াটুলীর জমিদার ওয়াইযের নীলকুঠির সামনে প্রতি পহলো বৈশাখে রাজ পুন্যাহ অনুষ্ঠান হতো। প্রজারা নতুন জামাকাপড় পরে জমিদারবাড়ি খাজনা দিতে আসত। জমিদাররা আঙ্গিনায় নেমে এসে প্রজাদের সাথে কুশল বিনিময় করতেন। সবশেষে ভোজপর্ব দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হতো।
পহেলা বৈশাখের রূপকল্পনায় উৎসবের ভূমিকা তাৎপর্যময়। পুরাতনের সাথে নতুনের যে যোগাযোগ পহেলা বৈশাখ তারই সূত্রধর। বৈশাখের ভোরের হাওয়া মনের চিরন্তন রূপের বর্ণালী ছড়াতে আরেক দিনের প্রভাত নতুনের বাণী শুনিয়ে হৃদয়ে দোলার স্পন্দন তোলে। আকাশবার্তা২৪ডটকম পরিবারের পক্ষ থেকে সবাইকে বাংলা নববর্ষ ১৪২০ এর শুভেচ্ছা।