মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১৩

শিকাগো থেকে সাভার... অধিকার নিশ্চিত করাই প্রতিকারের একমাত্র উপায়

মাউন উল করিম : আজ মহান মে দিবস, বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম আর সংহতির দিন। মেহনতি মানুষের ঘাম, রক্ত ও শ্রম অধিকারের বৈপ্লবিক অনুভব সঞ্চারিত হওয়ার দিন।  সভ্যতার সুচনা শ্রমের ভিত্তিতে হলেও একটা সময় ছিল যখন শ্রমিকের মর্যাদা বলে কিছু ছিল না৤ শ্রমিকদের নাম মাত্র মুজুরি দিয়ে মালিকরা ইচ্ছামত কাজ করাতো। তাদের কোন নির্দিষ্ট কর্ম ঘণ্টা ছিল না। এর প্রতিবাদ করলে মালিকরা চালাতো নির্যাতন। শ্রমিকদের ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা কাজে লাগিয়ে মালিকরা টাকার পাহাড় গড়ে তোলে। তখন শ্রমিকরা সংগঠিত ছিল না। বিচ্ছিন্নভাবে আন্দোলন করে তারা ক্ষতি ও নির্যাতনের শিকার হতো। ১৮৮৪ সালে আমেরিকার লেবার ফেডারশেন ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিকে জোরদার করে তোলে।
মালিকরা দাবি না মানলে অনির্দিষ্টকাল ধর্মঘট পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। ১৮৮৬ সালে ১ মে ধর্মঘট পালনের তারিখ নির্ধারিত হয়। সকল শ্রমিক সংগঠন ধর্মঘট পালনের একাত্মতা ঘোষণা করে। মালিকপক্ষ শ্রমিকদের আন্দোলন নস্যাৎ করতে অত্যাচার, হত্যা, গুম করার পথ বেছে নেয়। ১ মে ধর্মঘটের দিনের পূর্বে ৭ এপ্রিল মিসিসিপির এক কারখানায় ৮ শ্রমিককে হত্যা করে লাশ মিসিসিপি নদীর তীরে ফেলে রাখা হয়। এতে আন্দোলন জলে ওঠে। ১৮৮৬ সালে ১ মে আন্দোলন চরম অবস্থায় পৌঁছায়। আমেরিকার শিকাগো শহরে হে মার্কেটের জুতার কারখানা শ্রমিকগণ রাস্তায় নেমে ধর্মঘটে একাত্মতা ঘোষণা করে। আন্দোলন প্রতিহত করতে ৩ মে হে মার্কেটে আহুত ধর্মঘটি শ্রমিক সমাবেশে লেলিয়ে দেওয়া পুলিশের গুলিতে ৬ শ্রমিক নিহত হয়। এর প্রতিবাদে ৪ মে হাজার হাজার শ্রমিক বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ৪ মে প্রতিবাদ সমাবেশে পুলিশ আবারো গুলি চালায়। এতে ৫ শ্রমিক নিহত হয়।  প্রতিবাদ সমাবেশ চলাকালে প্রবল বৃষ্টির কারণে সভাস্থল থেকে লোকসমাগম কমতে থাকে। এ সুযোগে কুখ্যাত এক পুলিশ অফিসারের নেতৃত্বে ১৮০ জনের পুলিশ বাহিনী সভাস্থলে পৌঁছায়। পুলিশের প্রতি বোমা হামলার অভিযোগ এনে পুলিশ সমাবেশে গুলি চালায়। এতে ৫ জন নিহত ও শত শত লোক আহত হয়। পুলিশ শ্রমিকদের গ্রেপ্তার ও দমন পীড়ন নির্যাতন শুরু করে। আন্দোলন গড়ে তোলার অপরাধে ৮ শ্রমিকের বিচার করা হয় এবং কয়েক জনের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। ওই ৮ শ্রমিক নেতা হলেন এ্যালবাট পার্সস, আগাস্টাস স্পাইজ, স্যামুয়েল ফিভেন, মাইকল শোয়াব, জর্জ এঞ্জেল, লুই লিংগ, অ্যাডাল ফিফার ও ওস্কার নিব। বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যমে পার্সন্স, স্পাইজ, জর্জ এঞ্জেল ও ফিফারের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ফাঁসির আগের রাতে লুই লিংগ আত্মহত্যা করে। ১৮৯৩ সালের ২৬ জুন ইলিনবের গভর্ণর অভিযুক্ত ৮ শ্রমিক নেতাকে নির্দোষ বলে ঘোষণা দেন এবং পুলিশ অফিসারকে দোষী সাব্যস্ত করেন। এভাবে প্রাণের বিনিমিয়ে শ্রমিক শ্রেণী দৈনিক ৮ ঘণ্টা শ্রমের অধিকার আদায় করে। ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে প্রতিবছর ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক ঐক্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠার দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এখন সারা বিশ্বে মে দিবস পালিত হচ্ছে।

স্বাধীনতার পর থেকে দেশে সরকারিভাবে দিবসটি পালিত হচ্ছে। তবে এবারের মে দিবসের প্রেক্ষাপট ভিন্ন । শ্রমিকদের দাবি আদায়ের সংগ্রামে নির্যাতন-নিপীড়নের স্মারক হিসেবে যখন দিবসটি পালিত হচ্ছে ঠিক সেই মুহূর্তে রানা প্লাজার ধ্বংস্তূপের নিচ থেকে বের করে আনা হচ্ছে চাপা পড়া শ্রমিকদের লাশ। গলে পচে যাওয়া লাশের গন্ধ এখন সাভারের বাতাসে। ৮ ঘন্টা কাজের যে কর্মস্থল তা কতটুকু নিরাপদ একজন শ্রমিকের জন্য তা এখন প্রশ্নবিদ্ধ৤ দেশের সর্ববৃহত শিল্পখাতে একের পর এক বিপর্যয় শ্রমিকের নিরাপত্তাহীনতাকে অনেক বড় করে সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে আজ৤ প্রতিনিয়তই অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে এদেশের শ্রমিক জনতাকে রাস্তায় নেমে আসতে হচ্ছে৤ প্রতিদিনই তৈরী হচ্ছে পক্ষে ও বিপক্ষে নানা যুক্তি, শোনা যাচ্ছে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রতত্ত্ব যার ফলাফল স্বরূপ প্রতিনিয়তই দেখা যায় শ্রমিক অষন্তোশ৤ আর শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করাই এর প্রতিকারের একমাত্র উপায়৤ অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বুধবার দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে পালন করা হবে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, আলোচনা, মিছিল ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। তবে এদেশের শিল্পকে বাচিয়ে রাখতে হলে শ্রমিকের অধিকার সংরক্ষনের জাতীয় পর্যায়ে জরুরী ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন এখনই৤